দক্ষিণ গাবতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ইট সিমেন্টের একটা ধ্বংসস্তূপের কাঠামো দাড় করানো। এটা যে একটা শহীদ মিনার তা বোঝার কোন উপায় নেই। পলেস্তারা খসে খসে একেবারে হাড্ডিসার অবস্থা। অযত্ন অবহেলায় ভিতরের জং ধরা রড বের হয়ে এসেছে। কারো এদিকে খেয়াল নেই। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। ছাত্র-শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি কারো ভ্রুক্ষেপ নাই যে শহীদ মিনারটা মেরামত করা দরকার।
এটা আমাদের একটা স্মরণীয় ঐতিহ্যের প্রতীক। এক বেদনাময় আত্মত্যাগের দলিল শহীদ মিনার। কিন্তু আমাদের শহীদ মিনারের যে ভগ্ন দশা! মেরামত করা দরকার। বিষয়টা হেড স্যার কে জানানো উচিত। তুই কি বলিস রে তমাল?
হ্যাঁ ভালোই বলেছিস। বিষয়টা আসলেই একটা সেনসিটিভ ইস্যু। বাঙ্গালীর গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী শহীদ মিনারের এমন বেহাল দশা থাকতে পারেনা। এটা মেনে নেয়া যায় না। আচ্ছা তপু কি করা যায় বলতো?
হ্যাঁ বিষয়টা নিয়ে আমিও ভেবেছি। আমাদের তো কিছু একটা করতে হবে। আমার মাথায় একটা প্লান এসেছে। কি প্লান? আমরা কি করতে পারি? জিজ্ঞেস করে তমাল।
আমি চিন্তা করেছি আমরা একটা অ্যাপ্লিকেশন লিখব হেডস্যার বরাবর। বিষয় থাকবে শহীদ মিনার মেরামত করা প্রসঙ্গে।
গুড! গুড আইডিয়া। You are the great Topu. তুই আসলেই জিনিয়াস।
আরে থাম। এত পাম দিস না। আসল কাজ এখনো শুরু হয়নি। তবে সমস্যা একটা আছে।
কি সমস্যা? তমালের প্রশ্ন।
দরখাস্তটা কি আমাদের লেখা ঠিক হবে। আমাদের স্কুলের বড় ভাইয়েরা আছেন উনারা যদি কোন উদ্যোগ না নেয় তাহলে তো প্রবলেম হয়ে যাবে। স্যাররা যদি বলে তোমাদের এতো মাথাব্যাথা কেন? ক্লাস টেনের ছাত্ররা এমন একটা বিষয় নিয়ে লিখতে পারল না?
আরে ধুৎ এটা কোন বিষয় হল। তুই খামোখা চিন্তা করছিস। দেখিস স্যাররা আরো আমাদের বাহবা দিবেন। আর ওই শালাদের তো কোমর ভাঙ্গা। নইলে ওদের ক্লাসের মেয়ে আমাদের ক্লাসের জুনিয়রদের সাথে প্রেম করতে আসে!
তুই এসব কি বলছিস? ক্লাস টেনের মেয়ে নাইনের ছেলের সাথে প্রেম করে তোকে কথাটা কে বলল? অবাক হওয়ার ভান করল তপু।
বারে! আমরা বুঝি কিছু জানিনা। কাকের মতো চোখ বন্ধ করে লুকানোর চেষ্টা করা বোকামি। তোমার চোখ বন্ধ থাকলেও অন্য সবার চোখ কিন্তু খোলা। তুমি যে জয়াদির সাথে কবিতা আদান-প্রদান কর সেটা আমরা জানি।
দুর বোকা, কবিতা আদান-প্রদান করলেই কি আর প্রেম হয়! আর সিনিয়র দিদির সাথে প্রেম হয় নাকি? উনি আমাকে স্নেহ করেন। আমি কবিতা লেখি উনি তা জানেন বলেই তো সেদিন একটা কবিতা চাইলেন। সেটাই হয়তো শুনেছিস তোরা।
হ্যাঁ তা হতে পারে। তবে দিদির গতিবিধি কিন্তু যথেষ্ট সন্দেহজনক। সিনিয়র হয়ে জুনিয়রদের ক্লাস রুমে এত আনাগোনা কেন আমি বুঝিনা। আর্টসের ছাত্রী, সায়েন্সের ক্লাসে ঘোরাফেরা। নাহ মতিগতি খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না।
আরে থাম তো, যা বলছিলাম। তাহলে দরখাস্তটা লিখেই ফেলি কথা ঘুরানোর জন্য প্রসঙ্গ পাল্টায় তপু।
হ্যাঁ, তা করা যায়। কিন্তু একটু সাবধানে মাম্মা। আইড় মাছ ধরতে গেলে শক্ত করেই ধরতে হইব মাম্মা। মিটিমিটি হাসে তমাল।
এই চুপ করবি। ২১ শে ফেব্রুয়ারি কিন্তু চলে আসছে। শহীদ মিনারটা এখনও মেরামত করা হয়নি। কোথায় আমারে একটু হেল্প করবি তা না কইরা আছ শুধু ফাও প্যাঁচাল নিয়া।
তা যাই বল না কেন মাম্মা, দিদি কিন্তু হেব্বি, একাধারে সুনয়না, সুকেশী, দীর্ঘাঙ্গী। আর চেহারার কথা আর নাই বা বললাম। তুমি তো মাম্মা বড় ডাইন মারলা। এক্কেবারে বলিউডের নায়িকা। হা হা !!!
তপু চুপ করে আছে। তমালের কথার প্রতিবাদ করা মানে ওর অভিযোগ মাথা পেতে নেয়া। তাই চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করল ও।
আচ্ছা চল দেখি কি করা যায় বলে তমাল।
দ্বিতীয় পিরিয়ড শেষ না হতেই ক্লাস ক্যাপ্টেনদের ডাক পড়ল হেড স্যারের রুমে। তপু বেশ ভয়ে ভয়েই গেল। যেহেতু তপুই দরখাস্ত লেখার মূল হোতা তাই তার ভয়টাও বেশি। হেড স্যার খুব কড়া মানুষ। সামান্য এদিক সেদিক হলে জোড়া বেতের থেরাপি দিতে পিছপা হন না। আর কোথাও অযথা টাকা পয়সা খরচ করতে হবে শুনলে ওনার হাতের মুঠো আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, হেড স্যার তপুদের ডেকে উল্টো বাহবা দিলেন। এমন একটা জন গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য তপুকে ধন্যবাদ জানালেন। আর ২১ শে ফেব্রুয়ারির আগেই শহীদ মিনার মেরামতের অঙ্গীকার করলেন।
দেখতে দেখতে ২১ শে ফেব্রুয়ারি এসে গেল। ২১ শে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচী ঘোষণা করলেন হেড স্যার। ভোর ৫ টায় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ। তার পর প্রভাত ফেরি। প্রভাত ফেরির পর উপস্থিত বক্তৃতা এবং আলোচনা সভা। এবং সবশেষে একুশের গান।
শহীদ দিবস নিয়ে খুবই এক্সাইটেড তপু। ফুল দিয়ে শহীদ মিনার সাজানো, মঞ্চ সাজানো, প্রভাত ফেরির আয়োজন সব মিলিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে তপু। স্যাররা তপুকে ডেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। তপুর সাথে তমাল , আকাশ, আবির, সঞ্জয় ওরাও রয়েছে। তবুও তপুর উপরই স্যারদের যাবতীয় আস্থা।
তপুর মনে উচ্ছ্বাস আরও একটা কারণে। আজ জয়াদি আসবেন বলেছেন। জয়া এ বছর এসএসসি পরীক্ষার্থী। পরীক্ষার আর বেশি বাকী নেই। তাই বাসায় বসেই পড়াশুনা। কোচিং না থাকলে ক্লাসে আসা হয় না ওর। তপুর সাথে তাই যোগাযোগটা একটু কম। তবে তপুর ক্লাসমেট ববিতার মাধ্যমে জয়াদির যাবতীয় খবরই পায় তপু। ববিতাই বলল জয়াদি আজ আসবেন।
সকাল না হতেই প্রচুর ছেলেমেয়ে এসে জড়ো হল স্কুল মাঠের দক্ষিণ –পূর্ব কর্নারে শহীদ মিনারের পাদদেশে। তপুর বেশ ব্যস্ততা। সবাইকে লাইন ধরে দাড় করানো। এক এক করে শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার সুযোগ করে দেয়া। স্যাররাও প্রায় সবাই এসে গেছেন। কমল স্যার স্বাগত বক্তব্য দিলেন। তিনি একুশে ফেব্রুয়ারি কি এবং কেন এবং এর তাৎপর্য তুলে ধরলেন। তপুর চোখ খুঁজল জয়াকে। এমন একটা দিনে প্রিয়জনকে দেখতে পাবে না তা কি করে হয়? স্থানীয় এক সিনিয়র বড় ভাই সুন্দরীদের মনোযোগ আকর্ষনের জন্য নিজের আঙ্গুল কেটে শহীদ মিনারে রক্ত লেপ্টে দিলেন। সবাই তাকে বাহবা দিল। বা! বা! নাইন টেনের মেয়েদের সামনে হিরো সাজার চেষ্টা আরকি। তপুর নিজেকে কেন যেন হঠাৎ গুরুত্বহীন মনে হল। নিজেকে ভীরু এবং কাপুরুষের থেকে বেশি কিছু ভাবতে পারল না। মনে হল যেন মেয়ে গুলো ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। বিদ্রূপের হাসি। ধ্যাৎ জয়াও নাই যে--------। নাহ! এর জবাব দিতেই হবে। আশিক ভাইকে হিরো হতে দেয়া যাবেনা। ধীর পায়ে এগুলো শহীদ মিনারের বেদীর দিকে। আশিক ভাইয়ের কাছ থেকে ব্লেডটা চেয়ে নিল ও। অন্যদিকে তাকিয়ে বুড়ো আঙ্গুলে পোঁচ মারল তপু। মুহূর্তেই গড়িয়ে পরল তাজা রক্ত। তপু একটুও ভয় পেল না। বীরোচিত ভঙ্গিতে আঙ্গুল থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত লেপ্টে দিল শহীদ মিনারের কালো বেদীতে। মনে মনে ভাবল জয়া যদি এ দৃশ্যটা দেখত। কিন্তু হতাশ হল তপু। এতক্ষণে জয়ার মুখটা ও দেখতে পায়নি। তারমানে ও আসেনি। মনটা খারাপ হয় গেল তপুর। শহীদ মিনারের কাছ থেকে ফিরে আসার জন্য পিছন ফিরতেই জয়ার চোখে চোখ পড়ে গেল তপুর। বেদীর খুব কাছেই দাড়িয়ে আছে জয়া। অবাক হয়ে গেল তপু। কেমন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল জয়াকে দেখে। স্মিত হাস্যে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য নিয়ে দাড়িয়ে আছে জয়ন্তী চক্রবর্তী জয়া। শান্ত ডাগর চোখে খেলা করছে তার সীমাহীন শুদ্ধতা।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ওয়াহিদ মামুন লাভলু
সাহসের পরিচয়, মূল্যবান শিক্ষণীয় বিষয় আছে লেখায়। খুব ভাল লিখেছেন। শ্রদ্ধা জানবেন।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।